• সোমবার, ২০ মে ২০২৪, ৬ জৈষ্ঠ ১৪২৯

জাতীয়

সমুদ্রগামী জাহাজ ও নাবিকদের নিরাপত্তায় লাইট হাউস

  • ''
  • প্রকাশিত ০৩ এপ্রিল ২০২৪

তরিকুল ইসলাম সুমন:

সমুদ্রে চলাচলরত জাহাজ ও নাবিকদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য উপকূলীয় এলাকায় ৭টি লাইট হাউজ ও কোস্টাল রেডিও স্টেশন প্রস্তুত হচ্ছে। নৌ-পরিবহন মন্ত্রণালয়ের অধিনস্থ নৌ-পরিবহন অধিদপ্তরের ‘অ্যাস্টাবলিস্টমেন্ট অব গ্লোবাল মেরিটাইম ডিস্ট্রেস অ্যান্ড সেফটি সিস্টেম অ্যান্ড ইন্টিগ্রেটেড মেরিটাইম নেভিগেশন সিস্টেম (ইজিআইএমএনএস)’ প্রকল্পের আওতায় বাংলাদেশের পুরনো তিনটিসহ মোট সাতটি বাতিঘর নির্মাণকাজ শেষ পর্যায়ে। এখন চলছে কোরিয়ান বিশেষজ্ঞদের সহায়তায় সিস্টেম ইনস্টলেশনের কাজ। যা আগামী মে মাসের মধ্যে শেষ হবে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্ট প্রকল্প পরিচালক ক্যাপ্টেন আবু সাইদ মোহাম্মদ দেলোয়ার রহমান।

প্রকল্প পরিচালক বলেন, দেশের তিনটি লাইট হাউস থাকলেও সেগুলো এতো পুরাতন ছিল যে, এগুলোর কোনো যন্ত্রাংশ এখন আর পাওয়া যায় না। এ কারণে এগুলোও নতুনভাবে নির্মাণ করা হয়েছে। এছাড়াও নতুন করে আরো চারটি লাইট হাউস নির্মাণ করা হচ্ছে। এগুলোর সকল অবকাঠামো নির্মাণকাজ শেষ হলেও এখন সিস্টেম ইনস্টলেশন কাজ শুরু করেছেন কোরিয়ান বিশেষজ্ঞরা। বর্তমানে প্রতিটি লাইট হাউসে একটি করে কোস্টাল রেডিও স্টেশন স্থাপন করা হচ্ছে যা পূর্বে ছিল না। কোস্টাল রেডিও স্টেশনগুলো ব্যাকবোন নেটওয়ার্কের মাধ্যমে আগারগাঁও এ নির্মাণাধীন প্রধান কার্যালয়ে অবস্থিত কমান্ড অ্যান্ড কন্ট্রোল সেন্টারের সাথে যুক্ত থেকে বাংলাদেশের নিয়ন্ত্রণাধীন সমুদ্র এলাকা মনিটরসহ কোনো জাহাজ বিপদে পড়লে সেই জাহাজের সাথে যোগাযোগ স্থাপনসহ উদ্ধার অভিযানে নির্দেশনা দেওয়া যাবে। এতে আন্তর্জাতিক কনভেনশনের চাহিদা পূরণ হবে এবং মেরিটাইম নেশন হিসেবে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল হবে। নৌ-পরিবহন প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরী বলেন, দেশের উপকূলীয় এলাকায় সাতটি বাতিঘর নির্মাণকাজ শেষ হয়েছে। এখন ইনস্টলেশনের কাজ চলছে। এজন্য কোরিয়ান বিশেষজ্ঞরা কাজ করছেন। আশা করি, এগুলো চালু হলে বিদেশে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি বৃদ্ধি পাবে পাশাপাশি রাজস্ব ও পর্যটন শিল্পের প্রসার ঘটবে। তবে শুরু কিছুটা জটিলতা থাকলেও এখন কোনো সমস্যা নাই। সিস্টেম ইনস্টলেশনের কাজ শেষ হলে দ্রুত সময়ের মধ্যে এগুলো উদ্বোধন করা হবে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এগুলো উদ্বোধন করবেন।

পর্যটন ও অর্থনৈতিক সম্ভাবনা প্রসঙ্গে ক্যাপ্টেন আবু সাইদ মোহাম্মদ দেলোয়ার রহমান বলেন, বর্তমানে আমাদের কোস্টাল এলাকাতে কোনো জাহাজ আসলে আমরা তা জানতে পারি না। এই প্রকল্পটি বাস্তবায়নের মাধ্যমে আমাদের সম্পূর্ণ কোস্টাল এলাকা সার্ভিলেন্স এর আওতায় আসবে। প্রতিটি লাইট হাউস ৭৫ মিটার উঁচু এবং দৃষ্টিনন্দন যা পর্যটকদের আকৃষ্ট করবে। লাইট হাউস এলাকাকে এমনভাবে বিউটিফিকেশন করা হচ্ছে যা পর্যটকদের কাছে পরিচিতি পাবে। এছাড়াও ভ্রমণপিপাসুদের জন্য প্রকল্পের অধীনে লাইট হাউস কম্পাউন্ডে গেস্ট হাউস নির্মাণ করা হচ্ছে যেখানে পর্যটকগণ লাইট হাউসের সৌন্দর্য উপভোগের পাশাপাশি পরিবার নিয়ে নিরাপদে রাত্রিযাপন করতে পারবেন। স্থানীয় বাসিন্দাদের জন্য হবে বিনোদন কেন্দ্র এবং সমুদ্রগামী জাহাজের জন্য দিকনির্দেশক হিসেবে কাজ করবে। বর্তমানে বছরে এ খাত থেকে ৩০ কোটি টাকার রাজস্ব আসলেও ভবিষ্যতে ৬০ কোটি টাকার রাজস্ব আসবে বলেও তিনি জানান।

নৌ-মন্ত্রণালয়ের সূত্র জানায়, সমুদ্রে জাহাজ চলাচলের দিক-নির্দেশনা ও নিরাপত্তা দিতে সমুদ্রের ৩০০ নটিক্যাল মাইল পর্যন্ত এলাকা এই লাইট হাউসের আওতায় থাকবে। ফলে বাংলাদেশের সমুদ্রসীমায় চলাচলরত জাহাজের অবস্থা নিশ্চিত করা যাবে। সমুদ্রপথে বাণিজ্যিক জাহাজ চলাচলের দিক-নির্দেশনা ও যোগাযোগ স্থাপনে পটুয়াখালীর কুয়াকাটা, নোয়াখালীর হাতিয়ার নিঝুম দ্বীপ, ভোলার চরফ্যাশনের চর কুকরি মুকরি ও বাগেরহাটের দুবলার চরে নতুন চারটি লাইট হাউস নির্মাণ করা হয়েছে। এ ছাড়া ব্রিটিশ আমলে নির্মাণ করা কক্সবাজার সদর, কুতুবদিয়া ও সেন্টমার্টিন-পুরনো তিনটি লাইট হাউস সংস্কার পুনর্নির্মাণ করা হয়েছে। সমুদ্রে জাহাজের সঙ্গে ২৪ ঘণ্টা যোগাযোগ স্থাপনের জন্য কোস্টাল রেডিও স্টেশন (সিআরএস) স্থাপন করা হচ্ছে। ঢাকায় একটি কমান্ড ও কন্ট্রোল সেন্টার স্থাপনের মাধ্যমে জাহাজের সঙ্গে ২৪ ঘণ্টা যোগাযোগ প্রতিষ্ঠাসহ নৌ নিরাপত্তা ও নজরদারি নিশ্চিত করা যাবে রেডিও স্টেশনের মাধ্যমে।

এজন্য রাজধানীর আগারগাঁওয়ে নির্মাণ করা হয়েছে ১১তলা বিশিষ্ট ঢাকা কমান্ড অ্যান্ড কন্ট্রোল সেন্টার। এই ভবনটি নৌ-পরিবহন অধিদপ্তরের প্রধান কার্যালয় হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে। ইতোমধ্যে প্রকল্পের ৯৪ শতাংশ কাজ শেষ হয়েছে। চলতি বছরের জুনে পুরো প্রকল্পের কাজ শেষ হবে।

প্রকল্প সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, এই প্রকল্প বাস্তবায়নের মাধ্যমে নৌ সহায়ক যন্ত্রপাতি স্থাপন ও পরিচালনা করা, আন্তর্জাতিক কনভেনশনের চাহিদা পূরণ, আধুনিক নেভিগেশনাল সহায়তা ও ভেসেল ট্রাফিক ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে নৌ-নিরাপত্তা প্রসারিত করা, বর্তমান লাইট হাউস আধুনিকীকরণ ও নতুন লাইট হাউস স্থাপন, মেরিটাইম সার্চ অ্যান্ড রেসকিউ (অনুসন্ধান ও উদ্ধার) কার্যক্রমে সমন্বয় সাধন এবং সরকারের ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ায় সহায়ক ভূমিকা পালন করবে। ইতোমধ্যে প্রকল্পের ৯৪ শতাংশ কাজ শেষ হয়েছে।

ব্রিটিশ আমলে ১৮৪৬ সালে প্রথম তৈরি করা হয়েছিল কক্সবাজারের কুতুবদিয়া দ্বীপের লাইট হাউসটি। এটির উচ্চতা ১২৮ ফিট। এর বাতি প্রতি ১০ সেকেন্ড পরপর জ্বলে ওঠে। যা রাতে অনেক দূর থেকেও দেখা যায়। পরর্বর্তীকালে সেন্টমার্টিন দ্বীপে নির্মাণ করা হয় আরেকটি লাইট হাউস। এটিরও উচ্চতা ছিল ১২৮ ফিট। এটি প্রতি ৩০ সেকেন্ড পরপর বাতি জ্বলে। পরে কক্সবাজারের সদরে আরও একটি লাইট হাউস নির্মাণ করা হয়। ১৫ সেকেন্ড পর পর এর বাতি জ্বলে। এটির উচ্চতা ছিল ১৭৭ ফিট। এসব লাইট হাউস অনেক পুরনো হয়েছে। তাই এই লাইট হাউসগুলো পুনর্নির্মাণ করা হয়েছে।

প্রকল্পের অগ্রগতি প্রসঙ্গে প্রকল্প পরিচালক বলেন, মোটের উপরে প্রকল্পের কাজের অগ্রগতি ৯৪ শতাংশ। সাতটি বাতিঘরের প্রায় সবগুলোর কাজ শেষ হয়েছে। পুরনো কক্সবাজার বাতিঘরটি নতুন করে নির্মাণের জন্য ২০১৭ সালের ৯ মার্চ ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করা হয়। নির্মাণকাজ শুরু হয় ২০১৮ সালের ১১ আগস্ট। ইতোমধ্যে ৩ তলা কোস্টাল রেডিও স্টেশন, ২ তলা স্টাফ হাউস ও কোস্টাল রেডিও স্টেশন স্থাপন কাজ শেষ হয়েছে। বর্তমানে কক্সবাজার বাতিঘরে আইসিটি স্থাপনের যাবতীয় কাজ চলমান আছে। ৯৮ শতাংশ কাজ শেষ হয়েছে। এই মাসের মধ্যে শতভাগ কাজ শেষ হবে।

কুতুবদিয়ায় বাতিঘরের স্থানে নতুন করে টাওয়ার ও অন্যান্য স্থাপনা নির্মাণ করা হয়েছে। কুতুবদিয়া বাতিঘরের নির্মাণ কাজের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করা হয় ২০১৮ সালে ১৬ মার্চ। নির্মাণকাজ শুরু হয় ওই বছরের ১৪ আগস্ট। ইতোমধ্যে কুতুবদিয়া বাতিঘরের স্টিল লাইট টাওয়ার নির্মাণের কাজ শেষ হয়েছে। এ ছাড়া ৩ তলা কোস্টাল রেডিও স্টেশন, ২ তলা স্টাফ হাউস ও কোস্টাল রেডিও স্টেশন স্থাপন কাজ শেষ পর্যায়ে রয়েছে। সার্বিক অগ্রগতি ৯৫ শতাংশ।

সেন্টমার্টিনে বাতিঘর বা লাইট হাউস নির্মাণে ২০১৭ সালের ১০ মার্চ ভিত্তি প্রস্তর স্থাপন করা হয়। নির্মাণকাজ শুরু হয় ২০১৯ সালের ২৯ নভেম্বর। ইতোমধ্যে সেন্টমার্টিন লাইট হাউসের স্টিল লাইট টাওয়ারের ভিত ঢালাই সম্পন্ন হয়েছে। এ ছাড়া ৪তলা কোস্টাল রেডিও স্টেশন ও ২তলা স্টাফ হাউসের কাজও শেষ পর্যায়ে রয়েছে। সেন্টমার্টিন বাতিঘরের কাজের ৯৫ শতাংশ কাজ শেষ হয়েছে। নোয়াখালী জেলার হাতিয়ার নিঝুম দ্বীপের বাতিঘরটি নির্মাণে ২০১৮ সালের ২ মার্চ এটির ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করা হয়। নির্মাণ কাজ শুরু হয় ২০১৯ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি। ইতোমধ্যে স্টিল লাইট টাওয়ার ইরেকশনের কাজ সম্পন্ন হয়েছে। এ ছাড়া ৩ তলা কোস্টাল রেডিও স্টেশন ও ২ তলা স্টাফ হাউস নির্মাণ শেষ হয়েছে। সার্বিকভাবে ৯৫ শতাংশ কাজ শেষ হয়েছে।

পটুয়াখালীর কুয়াকাটায় বাতিঘরের ভিত্তি প্রস্তর স্থাপন করা হয় ২০১৪ সালের ১৭ আগস্ট। নির্মাণ শুরু হয় ২০১৮ সালের ১৬ নভেম্বর। ইতোমধ্যে স্টিল লাইট টাওয়ার, ৪তলা কোস্টাল রেডিও স্টেশন ও ২ তলা স্টাফ কোয়ার্টার নির্মাণকাজ শেষ হয়েছে। সার্বিক অগ্রগতি ৯৬ শতাংশ। ষষ্ঠ বাতিঘর নির্মাণ করা হচ্ছে ভোলার চরফ্যাশন উপজেলার চর কুকরি মুকরিতে। নতুনভাবে নির্মাণ করা এই বাতিঘরের ৭৫ মিটার দীর্ঘ স্টিল লাইট টাওয়ার নির্মাণকাজ শেষ হয়েছে। এ ছাড়া ৩তলা কোস্টাল রেডিও স্টেশন (সিআরএস) ভবন ও ২তলা স্টাফ হাউস নির্মাণকাজ শেষ হয়েছে। সার্বিক অগ্রগতি ৯৫ শতাংশ।

সপ্তম বাতিঘর নির্মাণ করা হচ্ছে বাগেরহাটের দুবলার চরে। নতুনভাবে নির্মাণ করা এই বাতিঘর ভিত্তি প্রস্তর স্থাপন করা হয় ২০১৮ সালের ১৮ মার্চ। নির্মাণকাজ শুরু হয় ২০১৯ সালের ২ ডিসেম্বর। ইতোমধ্যে বাতিঘরের স্টিল লাইট টাওয়ার নির্মাণ, ৩ তলা কোস্টাল রেডিও স্টেশন স্থাপন ও ২তলা স্টাফ হাউসের নির্মাণ শেষ পর্যায়ে রয়েছে। সার্বিকভাবে ৯৬ শতাংশ কাজ শেষ হয়েছে।

উল্লেখ্য, বাংলাদেশের উপকূলীয় এলাকায় লাইট হাউস ও কোস্টাল রেডিও স্টেশন স্থাপন এবং ঢাকায় একটি কমান্ড ও কন্ট্রোল সেন্টার স্থাপনে জন্য ২০১৪ সালে ইজিআইএমএনএস প্রকল্পটি গ্রহণ করা হয়েছিল। দুই বছরের মধ্যে প্রকল্পটি শেষ হওয়ার কথা থাকলেও তিন দফা ডিপিপি সংশোধন করে ২০২৪ সালে জুন পর্যন্ত প্রকল্পের মেয়াদ বৃদ্ধি করা হয়েছে। প্রকল্পের ব্যয় ধরা হয়েছে ৮১৮ কোটি ৭৫ লাখ ১১ হাজার টাকা। এর মধ্যে কোরিয়া ঋণ সহায়তা দিয়েছে ২৮৯ কোটি ১ লাখ ৮১ হাজার টাকা। বাকি ৫২৯ কোটি ৭৩ লাখ ৩০ হাজার টাকা সরকারি নিজস্ব ফান্ড থেকে ব্যয় করা হবে।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads